Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

স্বাধীনতা-উত্তর গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা

মো. কাওছারুল ইসলাম সিকদার
কৃষিই ছিল বাংলার আদি পেশা। এ অঞ্চলের মাটি, পানি তথা জলবায়ু ছিল কৃষির জন্য আদর্শ হিমালয়ের অববাহিকায় ভাটি অঞ্চলে বাংলার অবস্থান বিধায় অধিকাংশ নদী বাংলার উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। চীন, তিব্বত, নেপাল, ভুটান এবং ভারতের সীমানায় অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালার অসংখ্য হিমবাহের গলিত রূপ নদ  ও নদীরূপে বাংলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এ অঞ্চলকে করেছে সুজলা, শ্যামলা ও নদীমাতৃক। জীবন ও জীবিকাকে করেছে সহজ-সরল। মানুষকে করেছে কোমল। সংস্কৃতিকে করেছে বহুমাত্রিক। খাদ্যাভ্যাসও ছিল স্বতন্ত্র।
ফসল উৎপাদনের ধরন ছিল বহুমুখী। প্রতিটি কৃষি পরিবার তার প্রয়োজনের প্রায় সব শস্য ও মসলা উৎপাদন করত। সে সময়ে গম, কাউন, মটরশুঁটি, ডাল (মুগ, মসুর, মাসকালাই), ধনিয়া, পেঁয়াজ, রসুন, গোলআলু, মিষ্টি আলু প্রভৃতি ফসল উৎপাদন হতো। পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সবজি চাষ মূলত বাড়ির আশপাশে, ঘরের আঙ্গিনায়, ঘরের চালে মহিলারাই উৎপাদন করত। মাচা দিয়ে লাউ, বাঁশের কঞ্চিতে শিম আর ঘরের চালের উপর পাটখড়ির মাচায় চালকুমড়া ও মিষ্টি       কুমড়ার চাষ হতো। বাড়ির উঠানের এক পাশে ডাঁটা, ঢেঁড়স ও অন্যান্য শাক উৎপাদিত হতো। টমেটো, মুলা, ধনিয়া পাতা বাড়ির আশেপাশে বিদ্যমান ছোট জমিতে চাষ হতো। আর বড় বড় জমিতে ধান, পাট, গমসহ প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদন করা হতো। সে সময়কার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে মহিলাদের কাজকর্ম বাড়ির ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। অপরদিকে পুরুষেরা নিয়োজিত ছিল মাঠের কাজে, ফসল উৎপাদনে এবং অযান্ত্রিক পানি সেচে, খাদ্যশস্য পরিবহণ ও বাজারজাতকরণে। সত্তরের দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া কৃষিতে লাগেনি। তাই কৃষির সাথে সম্পর্কিত সকল কাজ, মূলত কায়িক শ্রম এবং গবাদিপশুর উপরই নির্ভর করতে হতো। জমি তৈরির একমাত্র অবলম্বন যাদের গরু কমছিল তারা অন্যান্য পরিবারের সাথে একত্র হয়ে সকলের গরু ও জোয়াল একত্র করে পালাক্রমে একে অপরের জমি তৈরি করত। সে সময়ে জমি চাষ ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার জন্য লাঙ্গল, জোয়াল, মই, আঁচড়া, কাঁচি, নিড়ানি পাতলা (রোদ ও বৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মাথায় দেওয়ার উপকরণ) প্রভৃতি ব্যবহার করা হতো এবং খাল-বিল, পুকুর ও ডোবা হতে সেচের পানি জমিতে দেয়ার জন্য কাঠের তৈরি দোরণ এবং বাঁশের তৈরি ওড়া ব্যবহৃত হতো।
গ্রামীণ সমাজে কৃষিসহ প্রায় সকল কাজই শুরু হতো সেই ভোর হতে এবং চলতো সকাল ৮-৯ ঘটিকা পর্যন্ত । এর পর সকালের খাবার এবং কিছুটা সময় বিশ্রাম নিত। সকালের খাবারে রাতের রান্না করা শুকনো/ পানি দেওয়া পান্তা ভাত এবং তার সাথে শুঁটকি ও অন্যান্য সবজি, ভর্তা, ভাজি ইত্যাদি থাকত।
ভোরে কাজ শুরু মূল লক্ষ্যই ছিল রোদ্রের প্রখরতা গায়ে লাগার আগেই যেন জমি তৈরির মতো পরিশ্রমের কাজ অনেকটা সম্পন্ন করা যায়। নাশতা ও বিশ্রামের পরে আবার কৃষকেরা মাঠে নেমে পড়তেন এবং চলতো দুপুর অবধি। একান্ত প্রয়োজন না হলে কৃষকদেরকে (বদলি) দুপুরের খাবারের জন্য বাড়িতে আনা হতো না। তাদের দুপুরের খাবার মাঠেই পৌঁছে দেওয়া হতো। যাতে করে সময়ের অপচয় না ঘটে এবং অধিক কাজ করা সম্ভব হয়। জমি তৈরি, ফসল উৎপাদন, কাটা, বাড়িতে আনা, শস্যের স্তূপ (গাদা), মাড়াই, সিদ্ধ, শুকানো, ঢেঁকিতে ছাঁটাই করে মটকা (মাটির বড় পাত্র), ডোল এবং গোলায় (পাটখড়ি বা বাঁশ দ্বারা নির্মিত) শস্য রাখা হতো। এ কাজগুলো মূলত পুরুষেরা করলেও ধান সিদ্ধ, শুকানো ও ঢেঁকিতে ভাঙ্গার কাজে মহিলারাই অংশগ্রহণ করত। গ্রামের   কৃষকেরা সাধারণত একত্র হয়ে পর্যায়ক্রমে অবস্থাপন্ন পরিবারের জমির ফসল মাঠ থেকে কেটে এনে দিত। একাজ সম্পন্ন হওয়ার পরে সচ্ছল পরিবারসমূহ পৃথক পৃথকভাবে পর্যায়ক্রমে কৃষকদের জন্য একবেলা ভালো খাবারের ব্যবস্থা করত। যা কৃষকদের মাঝে আনন্দ ঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করত। ধান কাটা শেষ হলে খেয়াঘাটের মাঝি, নাপিত ও অন্যান্য গরিব ও নিম্নবর্ণের মানুষেরা তাদের সেবার       বিনিময়স্বরূপ বার্ষিক মজুরি হিসেবে সচ্ছল পরিবার হতে ধান সংগ্রহ করত।
বাজার ছিল সপ্তাহে দুই দিন। মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাপ্তাহিক বাজার ব্যতীত নিকটবর্তী তেমন কোন দোকান-পাট ছিল না। তবে প্রতিদিন সকালে উক্ত বাজারসমূহে সকালে তাজা মাছ, সবজি, দুধ ও অন্যান্য উপকরণ স্বল্প সময়ের জন্য স্বল্প পরিসরে ক্রয়-বিক্রয় হতো। সকালের এই সংক্ষিপ্ত বাজার ব্যবস্থাপনা ‘আড়ং’ হিসেবে   প্রচলিত ছিল। সে সময় শিল্পের প্রসার ছিল না বললেই চলে। সরকারি চাকরিজীবীও গুটি কয়েক সরকারি ব্যাংকের মধ্যেই মূল অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যাংকার ভিন্ন অন্যদের হাতে নগদ টাকা ছিল না বললেই চলে। তাই অধিকাংশ মানুষ তার উদ্বৃত্তপণ্য বাজারে বিক্রয় করে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতো। সেসময়ে প্রাত্যহিক বাজারে প্রতিটি পরিবারের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ছিল লবণ ও কেরোসিন তেল। কারণ, এ দুটি পণ্য পারিবারিকভাবে উৎপাদনের সুযোগ ছিল না। তাই, রান্নার জন্য লবণ এবং প্রতিদিনের সাঁঝের আলোর জন্য কুপি ও হারিকেনে ব্যবহৃত হতো কেরোসিন তেল। কুপি ও হারিকেনের এ জ্বালানী সাশ্রয়ীর জন্য গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই সান্ধ্যকালীন কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া, শিশুদের পড়াশোনা এবং এশার নামায আদায় করে দ্রæত ঘুমিয়ে পড়ত। চিনি ছিল না বললেই চলে, তবে আখের গুড়ের প্রাপ্যতা ছিল পর্যাপ্ত। খাবার তেল বলতে সরিষার তেল ছিল প্রথম স্থানে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে তিলের তেল ও ব্যবহৃত হতো। এসবই ছিল বিশুদ্ধ। তেল ভাঙ্গানোর (তৈরি) জন্য কাঠের ঘানি ছিল; যা গরু দ্বারা চালানো হতো। ঘানি হতে উৎপাদিত তেল তেলবীজের মালিক পেতেন। অপর দিকে  খৈল (তেল বের হওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকত) ঘানিওয়ালা পেত। এ বার্টার ব্যবস্থা মূলত নগদ টাকার স্বল্পতার কারণেই প্রচলিত ছিল।
বাজার ব্যবস্থাপনা ছিল পণ্য বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম। অনেকগুলো গ্রামের জন্য ছিল এক একটি বাজার। তাই প্রতিটি পরিবারকে হাট দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হতো এবং প্রয়োজনের তাগিদে পরিবারের কোন না কোন পুরুষ সদস্যকে হাটে যেতে হতো। পুরুষ সদস্য না থাকলে প্রতিবেশীর নিকট পণ্য আনার জন্য অনুরোধ করতে হতো। সে সময়ে বর্ষায় মাঠঘাট পানিতে টইট¤ু^র থাকত। রাস্তাঘাট ছিল না। নৌকাই ছিল একমাত্র বাহন। তাই বাড়ির সকল পরিবার মিলে এক বা একাধিক নৌকায় বাজারে যেত।
টাকার তারল্যতা কম থাকায় প্রায় সকলেই উদ্বৃত্ত শস্য বাজারে নিত আবার ক্রয়কৃত পণ্য নিয়ে বাড়ি ফিরত। এমনকি শ্রমিকের মজুরি দেওয়া হতো হাটে পণ্য বিক্রি করে। অনেক ক্ষেত্রে সবজি জাতীয় পণ্যের দাম খুব কম বা চাহিদা না থাকলে তা বাজারেই ফেলে আসতে হতো। এসব সবজির মধ্যে ছিল টমেটো, খিরা, মুলা ইত্যাদি।  সবজির ওজন বেশি হওয়ায় বিক্রি না হলে বাজারে ফেলে আসা ছাড়া উপায় ছিল না।
বর্ষা মৌসুমে গ্রামের মাঠঘাট ছিল ধান ও পাটের সমারোহ। সেসময় পাটের চাহিদাও উৎপাদন ছিল ব্যাপক। অনুক‚ল পরিবেশ, বিশেষ করে স্বচ্ছ ও অথৈই পানি এবং সস্তা শ্রমিকের প্রাচুর্যের কারণে পাট উৎপাদন, কর্তন, জাগ দেওয়া, পাটখড়ি থেকে পাটকে পৃথককরণ, পাট ধোয়া এবং বাঁশের উপর পাট শুকানো ছিল গ্রামীণ বর্ষার অন্যতম চিত্র। সে সময়ে ধান ও পাট পৃথক জমিতে উৎপাদন করা হলেও কোন কোন কৃষক আউশ ধানের সাথে পাট একত্রে ফলাতেন। তৎকালীন সময়ে রাসায়নিক সারের প্রচলন ছিল না; তাই পাটের গোড়া জমিতে মিশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পেত।
খরিপ মৌসুমে আউশ ও আমন ধান ছিল কৃষকের প্রধান ফসল। প্রচলিত এসব ধানের কাÐ বর্ষার পানি বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পেত। তবে হঠাৎ অতিরিক্ত পানি বৃদ্ধি পেলে অনেক সময় ধান গাছ পানিতে তলিয়ে যেতে দেখা যেত। যার কারণে ধানের উৎপাদন কম হতো। অগ্রহায়ণ মাস ছিল ধান কাটার মৌসুম। ধান কাটার সময় ধানের খড় ও নাড়ার নিচে যে ধান ঝরে যেত তা গ্রামের  হত দরিদ্র মানুষ ঝাড়ু দিয়ে সে ধান সংগ্রহ করত। এ ছাড়া ধানী জমিতে প্রচুর ইঁদুরের গর্ত থাকত। ইঁদুর সাধারণত ধান কেটে গর্তে নিয়ে রাখত। গ্রামের গরিব মানুষ বিশেষ করে শিশু ও মহিলারা গর্ত থেকে সেই ধান সংগ্রহ করে বছরের খাদ্য চাহিদার কিছুটা পূরণ করত। সেসময়ে   প্রচলিত ধানের জাতসমূহ সুস্বাদু হলেও বিঘাপ্রতি ফলন ছিল খুবই কম। তাই প্রতি বছর নতুন ধান আগমনের পূর্বে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ খাদ্যাভাবের শিকার হতো। সে কারণে চালের স্বল্পতায় পরিবারের চাহিদা অনুযায়ী ভাতের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য চালের সাথে আলু কুঁচি করে একত্রে রান্না করতে দেখা যেত।
শীতকালে গ্রামের পরিবেশ ছিল উৎসব মুখরও কর্মচঞ্চলে ভরপুর। একদিকে নতুন ধানের আগমন অপরদিকে বিভিন্ন শস্যের জন্য জমি তৈরির প্রস্তুতি। নবান্নের বিশেষত্ব এই জন্য যে নতুন ধানের আগমনে কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে পরিবারের সদস্যের জন্য পর্যাপ্ত আহারের ব্যবস্থা সেই সাথে নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে হরেক রকম পিঠা ও মিষ্টান্ন তৈরির ধুম। নবান্ন হলে হরেক রকম পিঠাপুলি, মিষ্টান্ন, জালার জাউ (নতুন ধান হতে গাজন প্রক্রিয়ায় তৈরি একরকম খাবার) তৈরি হতো।
প্রচলিত এসব জাতের ধানের উৎপাদনকাল দীর্ঘছিল বিধায় তাহা ছিল অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এবং সুস্বাধু ও মিষ্টি। এক বা দুই সিদ্ধ ঢেঁকিছাটা পুষ্টিসমৃদ্ধ লাল চালই ছিল মানুষের প্রাত্যহিক খাবার। ধান কর্তনের পরপর নতুন ফসলের উৎপাদনের জন্য জমি চাষের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। সে সময়ে রাসায়নিক সারের প্রচলন ছিল না বিধায় জৈব ও সবুজ সারই ছিল জমির উৎপাদিকাশক্তি। বর্ষায় দুটি ফসল ধান ও পাটের আধিক্য থাকলেও রবিমৌসুমে কৃষকের চাহিদার প্রয়োজনে  বহুমুখী ফসল যেমন- গম, কাউন, মুগ, মসুর, মটরশুঁটি, কালাই, মাসকালাই, তিল, সরিষা, ধনিয়া, গোলআলু,         মিষ্টিআলুসহ পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ উৎপন্ন হতো। এছাড়া এসময়ে শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মুরগি, ডিম ও দুধের পর্যাপ্ত জোগান থাকত বিধায় গ্রামীণ জনপদের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ হতো।
বর্ষা, বন্যা এবং অথৈই নদীমাতৃক বাংলা ছিল মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ এবং অসংখ্য মিঠা পানির মৎস্যের অভয়াশ্রম। মাছের বিস্তৃত বিচরণ ক্ষেত্র, প্রাকৃতিক খাদ্যে ভরপুর বিশাল জলরাশি এবং দীর্ঘ সময় পানির স্থায়িত্বের কারণে প্রাকৃতিকভাবে মৎস্য সম্পদ বেড়ে উঠতো। তাই মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ছিল সর্বত্র। সেসময়ে মাছের প্রাপ্যতা ছিল সর্বত্র এবং মাছ ও ছিল সুস্বাদু। তাই সেøাগান ছিল “মাছে ভাতে বাঙালি”।
স্বাধীনতা-উত্তর গ্রামবাংলার প্রাণিসম্পদের চিত্র সমৃদ্ধতর ছিল না। এর দ্বারা সে সময়কার গ্রামীণ অর্থনীতিকে সহজেই অনুমান করা যায়। অনুন্নত জাত, রোগাক্রান্ত ও দুর্বল-স্বাস্থ্যহীন পশুই ছিল চাষাবাদের একমাত্র অবলম্বন। কারণ একটি দেশের অর্থনীতি তার গবাদিপশুর স্বাস্থ্যের অবস্থা থেকে সম্যক উপলব্ধি করা যায়। এছাড়া শস্য পরিবহণ ও মাড়াইয়েও গরু ও মহিষ ব্যবহার করা হতো। একাজে গরুর ব্যবহার প্রধান হলেও উত্তরবঙ্গে মহিষ চাষাবাদসহ পরিবহণ কাজে   অপেক্ষাকৃত বেশি ব্যবহার করা হতো। সেসময়ে গ্রামীণ সমাজে মানুষের জন্য চিকিৎসক পাওয়া ছিল দুষ্কর। তাই পশুর চিকিৎসক পাওয়া কথাছিল অবান্তর। সে সময়টা পশুর চিকিৎসা ব্যবস্থা মোটেও বিজ্ঞান সম্মত ছিল না। তাই বিভিন্ন রোগে তথা মড়কে অনেক গবাদিপশু মারা যেত। পুষ্টিকর পশু খাদ্যের অভাব এবং অনুন্নত স্থানীয় জাতের সাথে প্রজনন ব্যবস্থার কারণে গবাদিপশুর হাল ছিল খুবই দুর্বল।
সে সময়ে রাস্তাঘাট, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না বলে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন মৌসুমি ফল মূল স্থানীয় বাজার ভিন্ন অন্য কোথাও বিক্রির তেমন সুযোগ ছিল না। মূলত বাড়ির আঙ্গিনায় ও ঘরের আশপাশে উৎপন্ন ফলজ গাছ থেকে প্রাপ্ত ফলই ছিল মৌসুমি ফলের প্রধান উৎস।
প্রাকৃতিক বনায়নের পরিধি ছিল ব্যাপক। সারাদেশই মূলত ছিল ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছে ভরপুর। কারণ কৃষি ভিন্ন অন্যকোনো খাতের বিকাশ তখনও শুরু হয়নি। সামাজিক বনায়ন, কৃষি বনায়ন ছিল মানুষের চিন্তার অতীত।           মহাসড়কসমূহ ছিল অপ্রসস্থ এবং দেশে মহাসড়ক ব্যতীত তেমন কোন সড়ক ছিল না বললেই চলে। তাই সে সময়ে সামাজিক বনায়নের ভাবনা ছিল না। তবে মহাসড়কের দু’পাশে বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমলে লাগানো বড় বড় গাছ দেখা যেত।
স্বাধীনতা উত্তর গ্রামেই ছিল অধিকাংশ মানুষের বসবাস। নগরায়নের পরিধি ছিল খুবই কম। এ ছাড়া, পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল অনেক। তাই সে সময়ে গ্রামে মানুষ ছিল অনেক কিন্তু থাকার জন্য পর্যাপ্ত ঘর ছিল না। পরিবারের ৫ থেকে ৭ জন সদস্যকে এক একটি চৌকিতে ঘুমাতে হত। ঘরবাড়ির দেয়াল ছিল অধিকাংশই টিন, বাঁশ, মাটি দ্বারা তৈরি এবং চাল ছিল টিন অথবা শন দ্বারা নির্মিত। তবে হতদরিদ্র মানুষ তাদের ঘরবাড়ি চতুর্পাশ পাটখড়ি এবং উপরে শনের ছাউনি দ্বারা তৈরি করত। তবে সবারই মেঝে/ভিটি ছিল মাটির তৈরি। সে সুযোগে সিঁধেল চোরেরা রাতে ঘরের এক পাশের ভিটি কেটে চুরি করত। অভাব অনটনে জর্জরিত গ্রামীণ সমাজে সিঁধেল চুরি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সে সময়ে চৌকিদার ভিন্ন পুলিশের উপস্থিতি দেখা যেত না। স্থানীয়ভাবে সালিসির মাধ্যমেই চুরিসহ সমাজের প্রায় অধিকাংশ অনাচারের বিচার হতো। তবে অপেক্ষাকৃত বড় চুরি, অনাচার বা ডাকাতির ক্ষেত্রে পুলিশের হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে। অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার কারণেই প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ভিন্ন স্থানীয় সালিসির মাধ্যমেই গ্রামীণ সমাজের বিচারকার্য সম্পন্ন হতো। সে সময়ে গ্রামীণ জনপদে ব্রিটিশ আমলে তৈরি জমিদার বাড়ি ভিন্ন কোন দালানকোঠা চোখে পড়ত না। প্রায় সকল অবস্থাসম্পন্ন         কৃষকদের চৌচালা এক বা একাধিক টিনের ঘর বা বসতবাড়ি ছিল। অনেকের বাড়ির প্রবেশ পথে পথিক ও দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনের রাত্রি বাসের জন্য পৃথক ঘর ছিল। যা কাচারি ঘর নামেই পরিচিত। নিম্ন অবস্থা সম্পন্ন কৃষকদের ঘর সাধারণত একচালা টিন বা শনদ্বারা নির্মিত ছিল। রান্নাঘর বসতঘর হতে একটু দূরে পৃথকভাবে নির্মিত হতো এবং এগুলো সাধারণত শন বা পাটখড়ি দ্বারা তৈরি করা হতো। বাড়ির পুকুরই ছিল মানুষের গোসল, কাপড় ধোয়া এবং তৈজসপত্র পরিষ্কারসহ খাবার পানির উৎস। সাধারণত পুকুরের পানি সিদ্ধ করেই মানুষ পান করত। এ ছাড়া, গরু রাখার জন্য পৃথক গোয়ালঘর ছিল। অনেকে চোরের উপদ্রবের কারণে বসতঘরের প্রাচীর/দেয়াল ঘেসে এ গোয়ালঘর নির্মাণ করতেন। সে সময়ে কাঠামোগত কোন সৌচাগার ব্যবস্থা না থাকায় উন্মুক্ত ব্যবস্থাপনায় তা সম্পন্ন হতো। মানুষ বাড়ি হতে একটু দূরে ঝোপঝাড়ে অথবা খেতে প্রাকৃতিক কার্য সম্পন্ন করত। তবে বর্ষাকালে পয়ঃকার্য সম্পাদনের জন্য পানির উপর বাঁশের তৈরি ছোট্ট সাঁকোসদৃশ কাঠামো তৈরি করা হতো। অনেক কৃষক তাদের ছাগল ঘরের ভেতর রাতে রাখতেন। তবে মুরগি ও হাঁস প্রতিটি ধনী বা গরিব সবাই পালন করতেন। মহিলারা সাধারণত হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে নগদ টাকার প্রয়োজন মেটাতেন। প্রতিটি গ্রামে সাধারণত একটি মসজিদ ছিল।      পৃথক ঈদগাহ ময়দান তেমন ছিল না।
সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন- বিদ্যালয়, উপাসনালয়সহ বাজারের দোকানপাটসমূহ ছিল অনুন্নত ও জরাজীর্ণ। প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মসজিদসমূহের চুতর্পাশ ছিল বাঁশের তৈরি বেড়া এবং চালা ছিল টিনদ্বারা নির্মিত। খুঁটিসমূহ ছিল বাঁশ ও গাছের তৈরি। বিদ্যালয়ে বসার জন্য বেঞ্চ থাকলেও বই খাতা রাখা ও লেখার জন্য কোন উঁচু বেঞ্চ ছিল না। প্লে­অথবা নার্সারি নামে কোন ক্লাস না থাকলেও প্রাথমিকভাবে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন হওয়ার জন্য ছোট ওয়ান নামক ক্লাসের ব্যবস্থা ছিল। সে সময়ে ছোট ওয়ান থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীর স্কুল ছুটির পূর্বে একত্রে উচ্চস্বরে নামতা এবং বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালাসমূহ শিখত। এ ছাড়া ছোট ওয়ানের শিশুরা কাঠের তৈরি/পাথরের তৈরি সিলেট ও চক পেন্সিল দ্বারা বর্ণমালা ও সংখ্যা লেখার চর্চা করত। অনেকে মাটিতে দাগ কেটে বর্ণমালা লেখার চর্চা করত। সে সময়ে বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম থাকায় দূর-দূরান্ত হতে ছাত্রছাত্রীরা হেঁটে আসতে হতো বিধায় ক্লাস শুরু হতো একটু দেরিতে। তাই বিদ্যালয়সমূহে ক্লাস শুরু হতো সকাল ১০-১১ ঘটিকার মধ্যে। বিশেষ করে শিশুরা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে হালকা নাশতা হিসেবে মুড়ি, গুড় খেয়ে মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য যেত। মক্তবে পড়াশোনা শেষ করে বাড়ি ফিরে সকালের খাবার খেয়ে বিদ্যালয়ে গমন করত।
 নদীমাতৃক বাংলার যোগাযোগ ও পরিবহণের জন্য সে সময়ে প্রধান মাধ্যম ছিল জলপথ। সাধারণত বর্ষায় নদীপথে বড় বড় পালতোলা ডিঙ্গি নৌকায় পণ্য পরিবাহিত হতো। তবে খালের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবাহী ডিঙ্গি নৌকাসমূহকে শক্ত ও মোটা রশি দ্বারা বেঁধে এক বা একাধিক ব্যক্তি কর্তৃক খালের পাড়সমূহ অবলম্বন করে টেনে অগ্রসর হতে দেখা যেত। এসব নৌকা গুনটানা নৌকা বলা হতো। এটি যে কি কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ ছিল তা না দেখলে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। নৌকাতেই মাঝি মাল্লাদের রান্না বান্নার কাজ হতো। নৌকার পেছনে দিকনির্দেশক একটি বড় বৈঠা বা হাল থাকে। এ ছাড়া এক বা একাধিক ব্যক্তি লম্বা সরু বাঁশ অথবা বৈঠা চালিয়ে নৌকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিত। খালের উপরে কংক্রিটের স্থায়ী সেতু ছিল না বললেই চলে। মূলত ছিল বাঁশের তৈরি নিচু সাঁকো। নৌকা চলাচলের সময় সাঁকোর বাঁশ উঁচু করে তার নিচদিয়ে নৌকা চলাচল করত। পণ্য পরিবহণ ছাড়াও দূরের আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার জন্য বর্ষাই ছিল উপযুক্ত সময়। কাঠের তৈরি এবং নৌকার মাঝে বাঁশের ছাউনি দ্বারা নির্মিত ছোট কোশা ও কেরায়া নৌকায় পরিবারের সদস্যরা সকলে মিলে মৌসুমি ফল আম, কাঁঠাল এবং মিষ্টি ও পিঠা জাতীয় খাবার তৈরি করে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। মহিলা, শিশু এবং বয়স্কদের জন্য বর্ষাই ছিল আরামদায়ক ভ্রমণকাল। বর্ষার পানি নেমে গেলে মাঠঘাট কাদায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকত। এ সময়টি পণ্য পরিবহণ ও চলাচল জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। তবে শীতের প্রারম্ভে মাটি শুকিয়ে গেলে গ্রামীণ জনপদের চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসত। তাই এ সময়টি যেমন ছিল কর্মচঞ্চল তেমনি ছিল বিনোদন ও খেলাধুলায় ভরপুর। এছাড়া দিনে গ্রামীণ মেলা ও রাতে যাত্রা/ড্রামা উদযাপন করা হতো। এসব যাত্রায় আশপাশের     ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরের গ্রামের লোকজন অংশগ্রহণ করত। আলোর জন্য হ্যাজাক লাইট ব্যবহার করত। হ্যাজাক লাইটের চতুর্পাশে কাঁচ এবং ভেতরে অধিক আলোর জন্য নেটদ্বারা নির্মিত মেন্টেল ব্যবহার করা হতো। এ সকল লাইটের জ্বালানি ছিল কেরোসিন; যা পাম্পের মাধ্যমে মেন্টেলে কেরোসিন  প্রেরণ করা হতো এবং সেখান থেকে উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হতো। এ ছাড়া অঞ্চলভেদে পালাগানের আসর বসত। ধর্মীয় ও গ্রামীণ রক্ষণশীলতার কারণে পৌরাণিক ও অতীত কাহিনী নির্ভর এসব যাত্রা/ড্রামায় ছেলেরাই মেয়েদের অভিনয় করত। গ্রামীণ জনগণের কণ্ঠেছিল আব্দুল আলিমের মরমী ও আধ্যাত্মিক গান, আব্বাস উদ্দীনের পল্লীগীতি এবং কবি নজরুলের গজল। এ ছাড়া জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি এবং বাউল সঙ্গীত ছিল লোকের মুখে মুখে। শীতকাল ছিল খেলাধুলার জন্য উৎকৃষ্ট সময়। বড়রা ফুটবল ও ভলিবল, ছোটরা দাড়িয়া বান্দা, গোল্লাছুট, সাতচারা, মোরগ লড়াই এবং মেয়ে দেয় মাঝে দড়ি লাফ, কুতকুত, বৌচি, লুডু, ষোল গুঁটি প্রভৃতি খেলা জনপ্রিয় ছিল। সাধারণত ধানের জমির খড় ও নাড়াপুড়িয়ে/সরিয়ে ফেলে ফুটবল ও ভলিবল খেলার মাঠ তৈরি করা হতো। ভলিবল খেলা নিজেদের মধ্যে হলেও ফুল বল খেলা হতো আন্তঃ গ্রামের মধ্যে। শীতের শেষে বসন্তে ঘুড়ি ওড়ানো ছিল গ্রামীণ জনপদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
গ্রামীণ উৎসবের মধ্যে ইদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা এই দুই ঈদ, বিয়ে ও খৎনাজনিত উৎসবই ছিল প্রধান। দুই ঈদে গ্রামের সকলে এবং শহরে চাকরি ও ব্যবসায়ে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ একত্র হওয়ার সুযোগ পেত। দীর্ঘদিন পরে অনেকের সাথে সাক্ষাতের কারণে পারস্পরিক কুশল বিনিময়, কোলাকুলি এবং আপ্যায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদে আন্তরিকতা ও আনন্দ ঘনচিত্র ফুটে উঠত। আর্থিক দৈন্যতা এবং বস্ত্রশিল্পের অনগ্রসরতার কারণে অধিকাংশ মানুষই ঈদের নতুন কাপড় পরিধান করতে পারত না। তৈরি পোশাকের প্রাপ্যতা কম থাকায় দর্জি ছিল পোশাক তৈরির প্রধান মাধ্যম। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর পক্ষকে আপ্যায়নের শুরুতে মিষ্টি পানীয় (শরবত) এবং হাতে তৈরি পিঠা-পুলি ও মিষ্টি দ্বারা আপ্যায়ন করা হতো। অতঃপর প্রধান খাবার হিসেবে পোলাও, ভাত, মুরগির মাংস, খাশি/গরুর মাংস, মাসকালাইয়ের ডাল এবং সব শেষে চাল, গুড় ও দুধ দ্বারা নির্মিত মিষ্টান্ন (সিন্নি) পরিবেশন করা হতো। মোড়কীকরণ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না বিধায় বর ও কনে পক্ষ সাধারণত মাটির হাঁড়িতে করে একে অপরের বাড়িতে হাতে তৈরি পিঠা ও নিয়ে যেত দোকান থেকে মিষ্টান্ন (রসগোল্লা,  জিলাপি) তবে শীতকাল গ্রামের মানুষের জন্য কষ্টেরও কারণ ছিল। গ্রামের বসতবাড়ি ছিল খোলামেলা এবং শীতল বাতাস প্রবেশে বাধা দেওয়ার তেমন কার্যকর কোন ব্যবস্থা ছিল না। তাই রাতে ঠাÐায় শীতে মানুষ কষ্ট পেত এবং রোদ পোহানোর জন্য সুর্য উঠার অপেক্ষায় থাকত। এছাড়া, চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে সর্দি, কাশিসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগত। মূলত দুর্বল অর্থনৈতিকভিত্তি ও অবকাঠামোর কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্ভর ছিল গ্রামীণ মানুষের     জীবনযাত্রা, বিনোদন ও সার্বিক সমাজব্যবস্থা।
কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার নদী বিধৌত নিচু এলাকা যেখানে বর্ষায় ৫ থেকে ৬ মাস পানি থাকে, সে এলাকার গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা এখানে বর্ণিত হয়েছে। য়

কৃষি অর্থনীতিবিদ ও পলিসি স্পেশালিস্ট, উপসচিব, বিএফএসএ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : Kawserul1173@gmail.com

 


COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon